নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারে সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়া উচিত ; ওয়াকার-উজ-জামান; সেনা প্রধান ।

 ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সেজন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থনের যে অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান; সে সম্পর্কে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন বিএনপিসহ চারটি রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা। তাদের অভিন্ন ভাষ্য, ‘এটা সেনাপ্রধানের ব্যক্তিগত অভিমত ও পর্যবেক্ষণ হতে পারে।



গতকাল মঙ্গলবার ইত্তেফাকের সঙ্গে পৃথক আলাপকালে এই নেতাদের বেশির ভাগই বলেছেন—একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের লক্ষ্যে ন্যূনতম সংস্কারের জন্য ‘যৌক্তিক সময়’ শেষে দ্রুত নির্বাচন দেওয়া উচিত।

সোমবার বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে আগামী ১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হতে পারে, সেজন্য গুরুত্বপূর্ণ সংস্কারগুলো সম্পন্ন করতে এই সরকারকে সমর্থনের প্রতিশ্রুতির কথা জানান সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান। সেনাপ্রধান বলেছেন, সংস্কারের ধারাবাহিকতায় এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে গণতন্ত্রে উত্তরণ ঘটা উচিত। তবে, সেজন্য তিনি ধৈর্য ধরার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দেন।

এ বিষয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ইত্তেফাককে বলেন, ‘সেনাপ্রধানের সাক্ষাৎকারের বিষয়ে আমাদের (বিএনপির) কোনো বক্তব্য নেই। আমাদের কথা হচ্ছে—যতদ্রুত সম্ভব নির্বাচন করা দরকার। নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কার শেষে নির্বাচন হওয়া উচিত। যেন জনগণের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা সরকার পরিচালিত হতে পারে।’ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হয় শেখ হাসিনার সরকার। এরপর ৮ আগস্ট যাত্রা শুরু করে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর থেকেই এ সরকারের মেয়াদ নিয়ে নানামুখী আলোচনা-বিশ্লেষণ চলতে থাকে। বিএনপিসহ বেশির ভাগ দল শুরু থেকেই মৌলিক সংস্কারের জন্য অন্তর্বর্তী সরকারকে ‘যৌক্তিক সময়’ দেওয়ার কথা বলে আসছে।

এর প্রেক্ষিতে গত ২৮ আগস্ট জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ড. ইউনূস বলেছেন, ‘একটা বিষয়ে সবাই জানতে আগ্রহী—কখন আমাদের সরকার বিদায় নেবে। এটার জবাব আপনাদের হাতে, কখন আপনারা আমাদের বিদায় দেবেন। কখন নির্বাচন হবে সেটা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত, আমাদের সিদ্ধান্ত নয়। দেশবাসীকে ঠিক করতে হবে আপনারা কখন আমাদের ছেড়ে দেবেন।’

১৮ মাসের মধ্যে যাতে নির্বাচন হয়, সেজন্য অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে সমর্থনের যে অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছেন সেনাবাহিনীর প্রধান, সে বিষয়ে জাতীয় পার্টির (জাপা) চেয়ারম্যান জি এম কাদের ইত্তেফাককে বলেন, ‘এটা ওনার (সেনাপ্রধানের) অ্যাসেসমেন্ট হতে পারে। এতে খারাপ কিছু দেখি না। আমার মতে, সময়টা কমবেশিও হতে পারে। বিবেচ্য বিষয়টা থাকবে—এ সরকার সঠিক পথে চলছে কি না। সেজন্য আমরা অপেক্ষা করব। কারণ, শুধু একটা ভালো নির্বাচন হলেই হবে না; ভালো শাসনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। কেননা, দেশের বিদ্যমান শাসনব্যবস্থাই একটি জনপ্রিয় দলকেও সরকারে যাওয়ার পর দানবে পরিণত করে।’

গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের সঙ্গে সংস্কারের সুপারিশ প্রণয়নে গঠিত ছয়টি কমিশনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক শেষে সংবাদ ব্রিফিংয়ে এক প্রশ্নের জবাবে আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল বলেছিলেন, ‘সংস্কারের বিষয়ে ফ্যাসিবাদী দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা হবে। যারা গণহত্যা চালিয়েছে, হাজারের ওপর মানুষকে হত্যা করেছে, হাজার হাজার মানুষকে আহত করেছে, আয়নাঘর বানিয়েছে, যারা বিচারের ভয়ে পালিয়ে আছে—তাদের সঙ্গে আলোচনা হবে না। এটা আমাদের পরিষ্কার বক্তব্য।’

আসিফ নজরুলের এই বক্তব্য এবং আগামী নির্বাচনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ করা কিংবা করতে পারা না পারার বিষয়ে জাপা চেয়ারম্যান জি এম কাদের ইত্তেফাককে বলেন, ‘এ বিষয়ে এখনই মন্তব্য করা কঠিন। দুই-এক বছর গেলে পরিবেশ-পরিস্থিতি কী দাঁড়ায়, সেটা দেখতে হবে। আর আয়নাঘর সৃষ্টিসহ নানা অপরাধের জন্য দল হিসেবে হয়তো আওয়ামী লীগ দায়ী নয়; দলটির নেতৃত্বের দায় থাকতে পারে, দলটির সব নেতাকর্মী এগুলোর সঙ্গে নিশ্চয়ই জড়িত নয়। আবার এটাও বুঝতে হবে—শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগের বাইরেও দলটির পরিচ্ছন্ন কোনো নতুন নেতৃত্ব সামনে আসতে পারে। কাজেই বিষয়টি ভবিষ্যৎ এবং সময়ের ওপর ছেড়ে দেওয়াই উত্তম বলে মনে করি।’

আওয়ামী লীগের বিষয়ে একই প্রশ্ন রাখা হলে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) চেয়ারম্যান ড. কর্নেল (অব.) অলি আহমদ ইত্তেফাককে বলেন, ‘৮ আগস্ট প্রথম আমিই সংবাদ সম্মেলন করে বলেছি—যারা গণহত্যা, লুটপাট ও অর্থপাচারে জড়িত; যারা গণতন্ত্র ও নির্বাচনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করেছে; যারা গুম-খুন চালিয়েছে; যারা আয়নাঘর বানিয়েছিল; তাদেরকে রাজনীতি থেকে চিরবিদায় করতে হবে। রাজনৈতিক দল হিসেবে তাদেরকে নিষিদ্ধ করা উচিত, তাদের নিবন্ধন বাতিল করা উচিত। কারণ, আওয়ামী লীগ সরকার যে গণহত্যা চালিয়েছে তা পৃথিবীর একশ বছরের ইতিহাসেও কেউ ঘটায়নি।’

অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদসম্পর্কিত এক প্রশ্নে কর্নেল অলি বলেন, ‘কোনোভাবেই ১২ মাসের বেশি হওয়া উচিত নয়। এর বেশি হলে সরকার সবদিক নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না। আর রয়টার্সকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেনাপ্রধান কেন ১৮ মাসের কথা বলেছেন, সেটি আমার কাছে বোধগম্য নয়।’

জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার ইত্তেফাককে বলেন, ‘সেনাপ্রধানের মন্তব্যের বিষয়ে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই। সেনাপ্রধান হিসেবে তিনি তার পর্যবেক্ষণের কথা বলেছেন। আমাদের দলের প্রধানও বলেছেন— যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার শেষ করে নির্বাচন দেওয়ার জন্য। কারণ, আমরা মনে করি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টির জন্য ন্যূনতম যে সংস্কারগুলো করা দরকার, সেগুলো করা উচিত। রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে যে অনিয়ম-দুর্নীতি বাসা বেঁধেছে, সেগুলোর নিরসন প্রয়োজন। তবে, সমগ্র রাষ্ট্রের প্রতিটি খাতে যে দুরবস্থার সৃষ্টি হয়েছে— সেগুলো ঠিক করতে লম্বা সময় প্রয়োজন, এটা অরাজনৈতিক কোনো সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়, এটা তাদের দায়িত্বও নয়। সব রোগ-ব্যাধি এ সরকারই দূর করে দেবে, তা নয়। সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে সংস্কারগুলো দরকার, সেগুলো এ সরকারকে করতে হবে। এটিই যৌক্তিক সময়।’

এক প্রশ্নের জবাবে জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল বলেন, ‘এটা (বর্তমান সরকার) দেড় মাসের একটা শিশু, সে কখন হাঁটতে পারবে, সেটা সময়ই বলে দেবে। তাছাড়া, এ সরকারকে কতটা যৌক্তিক সময় দেওয়া যায়, তা নিয়ে আমাদের দলের অভ্যন্তরেও আলোচনা হচ্ছে। আরও কিছুদিন পর আমরাও আমাদের দলের পক্ষ থেকে নির্বাচনের একটা সময়সীমার কথা বলব।’

Post a Comment

Previous Post Next Post